বিচার ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য : ভারতীয় বিচারব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোয় বিচারব্যবস্থার একটি স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ ভূমিকা স্বীকৃত হয়েছে। ভারতীয় বিচারব্যবস্থার লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্যগুলি হল –
ভারতের বিচার ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য সমূহ –
এক ও অখণ্ড বিচারব্যবস্থা
ভারতে দ্বৈত বিচারব্যবস্থার পরিবর্তে সারা দেশের জন্য এক ও অখণ্ড বিচারব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এই অখণ্ড বিচারব্যবস্থার শীর্ষে রয়েছে সুপ্রিমকোর্ট। এ ছাড়া আছে অঙ্গরাজ্যগুলির সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্ট এবং বিভিন্ন ধরনের অধস্তন আদালত।
যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের উপস্থিতি
ভারতীয় বিচারব্যবস্থার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের উপস্থিতি। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্টকে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত বলা হয়। ভারতের সুপ্রিমকোর্ট একাধারে সংবিধানের অভিভাবক ও চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকর্তা এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের রক্ষা কর্তা। তা ছাড়া রাষ্ট্রপতির পরামর্শ দাতা হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে।
বিশেষ আদালতের অস্তিত্ব
ভারতের বিচারব্যবস্থায় কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ আদালতের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, শিল্পক্ষেত্রে শ্রমিক-মালিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য শিল্প আদালত (Industrial Court and Tribunals),
সামরিক বাহিনীর জন্য সামরিক আদালত (Military Courts), সরকারি কর্মচারী, স্থানীয় সংস্থা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের চাকরি-সম্পর্কিত যাবতীয় বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য প্রশাসনিক আদালত (Administrative Tribunal) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
লোক আদালতের অস্তিত্ব
অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য এবং মামলার ব্যয়ভার ও সময় হ্রাসের জন্য লোক আদালত গঠন করা হয়। ১৯৮৫ সালে লোক আদালতের সূচনা ঘটে। প্রসঙ্গত বলা যায়, ফৌজদারি বিরোধের ক্ষেত্রে লোক আদালতের কোনো এক্তিয়ার নেই।
লোক আদালতে পথ-দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণজনিত দাবি এবং বিবাহ- সম্পর্কিত বিরোধের দ্রুত মীমাংসা করা হয়। লোক আদালত ভারতের বিচারব্যবস্থায় একটি সাম্প্রতিক মৌলিক সংযোজন।
ক্রেতা আদালতের অস্তিত্ব
ক্রেতাদের স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্য ১৯৮৬ সালে ‘ক্রেতা সুরক্ষা আইন’ অনুসারে ক্রেতা আদালত গঠন করা হয়। ভারতীয় বিচারব্যবস্থার এটি একটি অভিনব বৈশিষ্ট্য। ক্রেতাদের স্বার্থ দেখাই হল এই আদালতের মূল কাজ।
কোনো ক্রেতা যখন কোনো জিনিস বা পরিসেবা কিনতে গিয়ে প্রতারিত বা বঞ্চিত হন তখন যে আইনগত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি প্রতিকার পেতে পারেন তাকে বলা হয় ক্রেতা আদালত।
স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা
ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় বিচারপতিরা যাতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য সম্পাদন করতে পারেন সেজন্য সংবিধানে কয়েকটি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত বিধিব্যবস্থা,
অবসরগ্রহণের পর কোনো আদালতে আইনজীবী হিসেবে কাজ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা, বিচারপতিদের রায়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিষয়টিকে পার্লামেন্টের ক্ষমতার বাইরে রাখা ইত্যাদি।
আইনগত সাম্যের স্বীকৃতি
ভারতের সংবিধানে আইনের দৃষ্টিতে সমতা (Equality before the law) ও আইন কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার (Equal Protection of Law) নীতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় এই দুটি নীতিকে অনুসরণ করা হয়েছে। তবে এই নীতিটির কিছু ব্যতিক্রমও লক্ষ করা যায়।
সংবিধানের ৩৬১ নং ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যপাল স্বপদে থাকাকালীন কয়েকটি বিশেষ ধরনের সুযোগসুবিধা ও অব্যাহতি ভোগ করে থাকেন। অন্যদিকে, আবার বিদেশি রাষ্ট্রের শাসক, বৈদেশিক রাষ্ট্রদূত এবং তাঁদের দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট বিদেশি কর্মীরা ভারতীয় আদালতের এক্তিয়ারভুক্ত নন।
প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ
ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি পূর্ণাঙ্গরূপে গৃহীত হয়নি। এই কারণে বেশ কিছু ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের ওপর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ বর্তমান। এই প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগে শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণের কথা উল্লেখ করা যায়।
বিশেষ আইনি সাহায্য
ভারতের মতো দেশে দরিদ্র জনসাধারণের পক্ষে অনেক সময় মামলার বিপুল ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব হয় না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী জনগণ যথাযথ ন্যায়বিচার লাভ থেকে বঞ্চিত হন। ভারতে বর্তমানে এই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণির জন্য সরকারি আইনি সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিচার বিভাগীয় সক্রিয়তা
ভারতীয় বিচারব্যবস্থার অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল বিচারবিভাগীয় সক্রিয়তা (Judicial Activism)। বিচার বিভাগীয় সক্রিয়তা বলতে সেই কাজকে বোঝায় যা আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের কর্মক্ষেত্রের ওপর বিচার বিভাগের প্রাধান্য বিস্তারকে সূচিত করে।
এক্ষেত্রে বিচারপতিরা শুধু যে প্রশাসনকে নির্দেশ দেন তাই নয়, তাঁরা গৃহীত ব্যবস্থাদির তদারকিও করে থাকেন। বিচারবিভাগীয় সক্রিয়তায় সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্ট প্রচলিত এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে জনস্বার্থের সঙ্গে জড়িত অনেক বিষয়ে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে। এর ফলে বিচার বিভাগের ভূমিকার সম্প্রসারণ ঘটেছে।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায়, ভারতীয় বিচারব্যবস্থা ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভারতীয় বিচারব্যবস্থা বর্তমানে সক্রিয় ও প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করে চলেছে। ভারতীয় শাসনব্যবস্থার এ এক আশাব্যঞ্জক দিক।